একজন মানুষের কি প্রতিদিন ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন আছে?
ভিটামিন ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর পেছনে একটি কারণ হচ্ছে মানুষের ভিটামিন গ্রহণের প্রবণতা। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা সংস্থা মিনটেল, তাদের জরীপে দেখিয়েছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ভিটামিন বা মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে।
বাজারে অনেক ধরনের সাপ্লিমেন্ট রয়েছে,
তার মধ্যে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ মাল্টি ভিটামিন। কিন্তু এর
মধ্যে কোনটা আপনার জন্য ভালো হবে তা বোঝা মুশকিল।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানবদেহেরর জন্য
১৩ ধরনের ভিটামিন প্রয়োজন। কিন্তু এগুলো কোনো ভিটামিনের জন্য আপনার কি সাপ্লিমেন্ট]
গ্রহণ করা প্রয়োজন- চলুন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।
ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট কি?
আমাদের কি প্রতিদিন ভিটামিন গ্রহণের প্রয়োজন আছে?
পানিতে দ্রবণীয়তার ওপর ভিত্তি করে দুই
ধরনের ভিটামিন পাওয়া যায়। একটি পানিতে দ্রবণীয়, অপরটি পানিতে দ্রবণীয় নয় তবে চর্বিতে
দ্রবণীয়।
চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলো হলো- ভিটামিন
এ, ডি, ই এবং কে। এগুলো আপনার শরীরের মাধ্যমে জমা হয়। সুতরাং প্রতিদিন এরকম ভিটামিন
না খেলেও আপনার শরীরে এই ভিটামিনগুলোর সরবারহ বজায় থাকবে।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলো হলো- ভিটামিন
এ, সি এবং বি ভিটামিন যেমন- ফলিক এসিড। আপনার শরীরের মাধ্যমে এগুলো জমা হয় না। সুতরাং,
আপনাকে প্রতিদিন এই জাতীয় ভিটামিনগুলো গ্রহণ করতে হবে, যাতে আপনার শরীরে এসবের সরবারহ
ঠিক থাকে। যদিও ভিটামিন বি-১২ লিভারের মাধ্যমে শরীরে জমা হতে পারে। কিছু মাল্টি ভিটামিনে
মিনারেল এবং জিঙ্ক, আয়রন, ক্যালসিয়ামের মতো রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। আপনার ডায়েট থেকে
এই তিনটি খনির পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া সম্ভব। তবে যদি আপনার শারীরিক চাহিদা আরও বেশি
থাকে তাহলে চিকিৎসকই আপনাকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন গ্রহণের পরামর্শ দেবেন।
ক্যালসিয়াম- এটি শক্তিশালী হাড় গঠনের
জন্য প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ৭০০ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।
জিংক- এটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও
পরিপাক তন্ত্রের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের প্রতিদিন ৭ মিলিগ্রাম
এবং পুরুষদের ৯.৫ মিলিগ্রাম জিংক প্রয়োজন।
আয়রন(লৌহ)- আয়রন খাদ্যের জন্য শক্তি
খরচ ও রক্তের চারপাশে অক্সিজেন সরবারহের জন্যও অনেক জরুরী। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের
প্রতিদিন ১৪.৮ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন হয় এবং পুরুষদের ৮.৭ মিলিগ্রাম প্রয়োজন হয়।
ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট কাদের জন্য দরকার?
যারা দিনের বেলায় রোদের সংস্পর্শে আসতে
পারে না, তাদের জন্য ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নেওয়া খুব জরুরী। কিন্তু ভিটামিন-ডি পাবেন
একদম বিনামূল্যে যদি আপনি সূর্য এর আলোতে যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার দিয়ে শরীরের
ভিটামিন-ডি এর চাহিদা খুব কম পূরণ হয়। এই ভিটামিন শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সূর্য
থেকে আসা আলো ছাড়া মানুষের দেহ ভিটামিন ডি তৈরি করতে পারে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাক্তার
কানিজ মাওলা বলেছেন, “ মানুষের ত্বকের নিচে এক ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। সূর্য এর আলোতে
গেলে তা ভিটামিন ডি তৈরি করে। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম তৈরি করে তা ব্যবহারে শরীরকে সহায়তা
করে। এই প্রক্রিয়ার শুরু সূর্য এর আলোর সাথে ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে “
ভিটামিন ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরকে সহায়তা করে। এটি পর্যাপ্ত না পেলে নানা ধরনের
রোগ দেখা দিতে পারে। এই একই ভিটামিন শরীরের ফসফেট নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুস্থ পেশীর জন্যও
এটি দরকার।
চিকিৎসকরা সাধারণত ক্যালসিয়ামের জন্য
নিয়মিতভাবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ১৫-৩০
মিনিট সূর্য আলোতে থাকার পরামর্শ দেন। বিশেষজ্ঞরা দিনের শুরু দিকে সূর্য আলো শরীরের
জন্য ভালো বলে উল্লেখ করেন।
যাদের ক্ষুধা কম এবং বয়স্ক, তারা প্রয়োজনীয়
মাল্টি ভিটামিন গ্রহণ করে উপকৃত হতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ
নিতে হবে। বয়স্ক বা ঘরে যারা বেশির ভাগ সময় থাকেন তাদের ক্যালসিয়াম সহ ভিটামিন-বি সাপ্লিমেন্ট
গ্রহণ করা উচিত। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
লাইফ স্টাইল হোক বা ওজন কমানোর জন্য
হোক, নির্দিষ্ট কোনো ডায়েটে থাকলে শরীরের পর্যাপ্ত পুষ্টির জন্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট
গ্রহণ করা উচিত। আর আপনি যদি লো ক্যালরি ডায়েটে থাকেন, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে মাল্টি
ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।
তাছাড়া ডেইরি ফ্রি ডায়েট হলে ক্যালসিয়াম
সাপ্লিমেন্ট বা ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত। ভেগান ডায়েট যারা করেন এবং
যারা প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে না, তাদের ভিটামিন বি-১২ এবং ক্যালসিয়ামের
ঘাটতি তৈরি হবার যথেষ্ট সম্ভবনা থাকে। সুতরাং তাদের এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা
জরুরী।
কিশোরী এবং নারী, যাদের পিরিয়ডের সময়
অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, তারা হয়তো আয়রনের ঘাটতি পূরনে যথেষ্ট খাবার খান না। তাদের আরও
সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ডায়েট এন্ড নিউট্রিশন
সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪.৮ শতাংশই আয়রন ঘাটতি জনিত
অসুখে অ্যানিমিয়াতে (রক্ত স্বল্পতা) ভুগছেন। আর আয়রন স্বল্পতায় ভুগছেন ১২.৫% নারী।
যে সকল নারী গর্ভধারনের চেষ্টা করছেন এবং যারা গর্ভাবস্থার
প্রথম ১২ সপ্তাহে আছেন, তাদেরকে চিকিৎসকেরা ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ
দিয়ে থাকেন। এটি তাদের সন্তানদের স্পাইন আপ বিজেপির মতো নিউরাল টিউব ত্রুটির ঝুঁকির
হ্রাস করে।
ভিটামিন সি ট্যাবলেট আসলেই জীবন রক্ষাকারী নাকি সময় নষ্টকারী?
ভিটামিন সি একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট
ও সুপার ফুড হিসেবেও এর খ্যাতি রয়েছে রয়েছে। যদিও বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, রোগ বা ঠান্ডাজনিত
সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণে ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ করে, সেরকম প্রমাণ তেমন পাওয়া যায়
নি। শরীর কিন্তু অতিরিক্ত ভিটামিন সি জমিয়ে রাখতে পারে না। এই ভিটামিন সি শরীরের ভেতরের
বিক্রিয়ার কারণে যে সব কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেগুলো সারিয়ে তুলতে কাজ করে। ফলমূল ও
শাক সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। টক জাতীয় যে কোনো ধরনের ফল, যেমন- লেবু,
আমলকি, কমলা, বাতাবি লেবু, পেয়ারাতে ভিটামিন সি আছে। একটা কমলায় প্রায় ৭০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি থাকে। যদিও ৪০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সুতরাং এমন
খাবার গ্রহণে ভিটামিন সি এর ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।
আমাদের দেহে কত ধরনের ভিটামিন প্রয়োজন?
আপনার শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলগুলো
শুধু আপনার জন্যই প্রযোজ্য হবে। আপনার বয়স অ্যাক্টিভিটি লেভেল, লিঙ্গ এবং অন্যান্য
বিষয়গুলোর উপর এটা নির্ভর করে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে, ভিটামিন ডি বাদে
আমাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত ভিটামিন ও মিনারেল একটি স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার খাদ্যাভাস
থেকে পেতে পারি। তবে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে অনেকে নিয়মিত খাদ্যাভাসের মাধ্যমেও পরিমিত
ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বিভিন্ন ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করছে।