রিজার্ভ আসলে কী, কীভাবে রাখা হয়, কেন দরকার?

রিজার্ভ, যে শব্দটি রাজনীতিবিদ থেকে  শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই প্রায় সময় ব্যবহার করছেন। সেই রিজার্ভ বিষয়টা আসলে কি এবং এটি বাড়লে এবং কমলে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়বে, চলুন তা আমরা জেনে নেব।

রিজার্ভ আসলে কী, কীভাবে রাখা হয়, কেন দরকার?

রিজার্ভ কি?

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে বুঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আমরা সবাই জানি, বেশ কিছুদিন ধরে তরতর করে উপরে ওঠার পর সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর পরিমাণ মান কেবল কমছে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বলতে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদ এর মজুদকে বোঝায়। রপ্তানি, রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়, ঋণ এবং অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বৈদেশিক শিক্ষা-ভ্রমণ ব্যয় ইত্যাদি নানা খাতে খরচ হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ বা ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ। সহজ করে বলতে গেলে, দেশের আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে ব্যয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ।
এটি বৈদেশিক দায় পরিশোধের জন্য রাখা হয় এবং মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদের মতে, মুদ্রার ভালো রিজার্ভ থাকার মানে হল দেশের আমদানি সক্ষমতা আছে।
এই নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে, তবে সাধারণভাবে বলা হয় যে একটা দেশের তিন মাস এর আমদানি খরচের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা খুব প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের হাতে যত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে ততই দেশটির ব্যাপারে বিদেশিদের আস্থা থাকবে।

রিজার্ভের অর্থ কিভাবে রাখা হয়?

একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারে। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মার্কিন ডলারে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণ করে। এর একটি কারণ, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মুদ্রা। এবং এটি বেশ স্থিতিশীল মুদ্রাও বটে। ডলার ছাড়াও বাংলাদেশ ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, চীনের ইউয়ান এবং জাপানের ইয়েন রিজার্ভ সংরক্ষণ করে। ডলারের পরিমাণ হিসাব করলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে চীনের কাছে। দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় তিন ট্রিলিয়ন বা ৩০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে হিসাব অনুযায়ী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ৩৬.৪৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF রিজার্ভ হিসাব করার যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছে, তার হিসেবে রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাড়ায় ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি

কোন কোন খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আছে?

রেমিটেন্স

বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পাঠানো অর্থ, যা বহুলভাবে পরিচিত রেমিটেন্স হিসেবে। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা সব দেশেই বিদেশী মুদ্রার মজুদ করে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে গড়ে ওঠা রিজার্ভের একটি বড় অংশ এটি 

রপ্তানি আয়

বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রায় সবচেয়ে বড় চালানটি আসে রপ্তানি আয় হিসেবে। ছোট একটি দেশ হলে রপ্তানির আকার বাড়ছে। এরই মধ্যে গার্মেন্টস এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ। শিল্প পণ্য ছাড়াও বাংলাদেশ সেবাপূর্ণ রপ্তানি করে। বিদেশে বিভিন্ন পণ্য বা রপ্তানি বাবদ যে আয় হয় তা থেকে রিজার্ভের একটা বড় অংশ আছে বাংলাদেশে।

বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান

বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বিশ্ব ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF, এশীয় উন্নয়ন  ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার যে ঋণ নেন সেটিও রিজার্ভের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া বিভিন্ন দাতা দেশের কাছ থেকে আশা অনুদানও যোগ হয়ে রিজার্ভে।

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআর

বিদেশী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সরাসরি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে, তাহলে সেখান থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে একটি দেশ, যা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করে।

রিজার্ভ কেন দরকার?

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান সিটি ইন্ডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, মূলত বিদেশী মুদ্রা স্বর্ণের মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয়। তবে এর বাহিরে বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড, সরকারি সিকিউরিটিজ, ট্রেজারি বিল ইত্যাদির মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষণ করে। সিটি ইনডেক্সের মতে, মূলত সাতটি কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ সংরক্ষণ করে থাকে।

১. স্থানীয় মুদ্রা মূল্যবান নির্ধারণ

কোন দেশে নিজস্ব মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পূরণ করে কোন দেশের মুদ্রা অন্য দেশের মুদ্রা যেন দাম না হারায় সে জন্য ভালো রিজার্ভ থাকা জরুরী । অনেক দেখে নিজের মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে ডলারের মুদ্রার মান ঠিক করে দেয়।

২. ডলারের বিপরীতে এই স্থানের মুদ্রার মূল্য কম রাখা

রপ্তানিকে প্রতিযোগিতামূলক করতে অনেক সময় নিজস্ব মুদ্রার মূল্য মান ডলারের বিপরীতে কমে রাখা। এটা যেমন অনেক দের সরাসরি করে আবার অনেক দেশ বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে এটি করে থাকে। যেমন জাপান দেশটির ভাসমান বিনিময় হার অনুসরণ করে অর্থাৎ জাপানে ডলার সহ বিদেশি মুদ্রার দাম নির্ধারণ হয় বাজারে চাহিদা সে অনুযায়ী যোগানের ভিত্তিতে তবে নিজস্ব মুদ্রার ইয়েনের দাম ডলারের তুলনায় কম থাকে সেজন্য দেশটি বড় পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের বড় ট্রেজারি বন্ড কিনে থাকে। আর ইয়েন দুর্বল থাকার কারণে দেশটির রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক থাকে।

৩. তারল্য নিশ্চিত করা

কোনে সংকটের কারণে যদি কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অভ্যন্তরীন যোগান বা তারল্য কমে যায়, তখন সেটি নিরসনে পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মূদ্রার সরবারহ বাড়াতে তার হাতে থাকা বৈদেশিক মূদ্রা বিক্রয় করে। এতে যোগান নিশ্চিত থাকে। এর ফলে একটি ব্যবসা অন্য দেশের সাথে সহজে আমদানি রপ্তানি করতে পারে।

৪. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শর্ত পূরণ

একটি দেশের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্য শর্ত পূরণ বা বাধ্য-বাধকতা পূরণেও বৈদেশিক রিজার্ভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর আওতায় থাকে

১. ঋণ ও বিল পরিশোধ

২. আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ

৩. হঠাৎ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তর

৫. অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন

দেশের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবহার করা হতে পারে। যেমন- বাংলাদেশে পায়রা সমুদ্র বন্দরে সুযোগ সুবিধা বাড়াতে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই খরচের একটি বড় অংশই রিজার্ভ থেকে আনা হয়েছে বিনিয়োগ হিসেবে।

৬. বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা

যুদ্ধ কিংবা অভ্যন্তরীন অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক সময় বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়না। এর পরিবর্তে তারা বিদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। এমন অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের কাছে স্বস্তি হিসেবে কাজ করে রিজার্ভ। বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ভালো থাকলে তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্নবিশ্বাস বাড়াতেও সাহায্য করে। তারা মনে করেন, তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তারা বৈদেশিক মূদ্রাতেই ফেরত পেতে পারবেন। এতে সরাসরি বিনিয়োগও বাড়ে।

৭. পোর্টফোলিও বহুমুখী করা

রিজার্ভ হিসেবে বিভিন্ন মূদ্রা সংরক্ষণ করা হলে তা কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ঝুকি কমিয়ে আনে। এটি সংশ্লিষ্ট দেশকে একধরনের সুরক্ষাও দিয়ে থাকে। যেমন- বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ডলারে নয় বরং ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান ও সিঙ্গাপুরী ডলার, ইয়েন, ইউয়ান, স্বর্ণ ইত্যাদিতে রিজার্ভ সংরক্ষণ করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url