চিনি ও মিষ্টি : শরীরের জন্য কতটা ভাল ও কতটা খারাপ?

চিনি ও মিষ্টি : শরীরের জন্য কতটা ভাল ও কতটা খারাপ?

চিনি ও মিষ্টি : শরীরের জন্য কতটা ভাল ও কতটা খারাপ?

চিনি, শর্করা, সুগার- যে নামেই ডাকুন গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের ক্রমাগত সতর্ক বার্তার ফলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু। আমরা সব সময় শুনেছি, যারা বেশি মিষ্টি খায়, তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এর বিপরীতেও একটা কথা আছে, এসব স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য শর্করা দায়ী তা হয়তো নাও হতে পারে। মিষ্টি কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা বের করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন।
  • উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের ঝুঁকি তখনই হয় যখন আপনি উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার সাথে উচ্চ মাত্রার শর্করা সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। শুধু মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবারের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয় এটা বলা যাবে না।
তাছাড়া একটি খাবারকে সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা অনেক বিপদ আছে। কারণ এর ফলে এমন হতে পারে মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হয়তো আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
চিনি- শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এই চিনি বা শর্করা জাতীয় খাবার বা মিষ্টি খাওয়া নিয়ে আমাদের মাঝে ভীতির শেষ নেই। মিষ্টি নিয়ে নানা জাতীয় কথা প্রচলন আছে। চলুন আজ কয়েকটা জেনে নেওয়া যাক।

মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবারে ওজন বাড়ে

বাঁচতে হলে চিনি ছাড়ুন, মিষ্টি ছাড়ুন- এই কথার কোন ভিত্তি নেই। অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টির শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চিনিজাতীয় খাবারে অনেক ক্যালরি থাকে। আর অনেক গ্রহণ করলে তা মিষ্টি খাবার হোক বা অন্য কোন উপায়ে ওজন বাড়বে, এটাই তো স্বাভাবিক। পুষ্টিবিদেরা বরাবরই বলে আসছেন, চিনি জাতীয় খাবার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা মেটাতে কী পরিমাণ মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবার প্রয়োজন সেটি জানতে হবে। কারণ শরীরে যতটুকু চিনি দরকার ততটুকু নিতে হবে, কম বা বেশি দুটিতেই বিপত্তি হতে পারে।

মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়

বিজ্ঞানীরা বলছেন উচ্চ মাত্রার ফ্রুকটোজ সমৃদ্ধ কর্ণ সিরাপ বা বাড়তি চিনিযুক্ত পানীয়- জুস ড্রিংক, মধু বা সাদা চিনি এগুলো হৃদ যন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ তা ধমনীর ভিতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি জমাতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা চিনিসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় এর সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। কিন্তু চিনির কারণে যে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস হয়, এটা স্পষ্ট করে বলার উপায় এখনো নেই।
লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুক টাপি বলেছেন,

"অতিরিক্ত ক্যালরি ডায়াবেটিস স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ এবং সুগার সেই উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র।"

এছাড়া আর টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস, কিছু জেনেটিক ও পরিবেশ গত কারণে হয়ে থাকে। সেখানে শুধুমাত্র মিষ্টি শর্করা জাতীয় খাবার কে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

অতিরিক্ত মিষ্টি মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে

অনেকে বলে থাকেন বাচ্চাদের হাইপারঅ্যাক্টিভ করে তুলে মিষ্টিজাতীয় খাবার। কিন্তু গবেষণা বলেছেন, এ ধারণার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিছু গবেষণা বলা হয়, চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার আকর্ষণ, কোকেনের আকর্ষণের মতোই, যাকে বলা হয় চলে একটা নেশা। কিন্তু এসব গবেষণার বিরুদ্ধে এমন সমালোচনা হয়েছে যে, এখানে উপর থেকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিছু জরিপে বলা হয়েছে যারা বেশি কোমল পানীয় বা ফলের রস খান তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল মস্তিষ্কের গড় আয়তন ও কম।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন সেন্টারের গবেষক, ম্যাথিউ পেস বলেছেন,

"তাছাড়া এমন হতে পারে যারা বেশি সফট ড্রিংকস পান করেন তারা হয়তো কম শরীরচর্চা করেন। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যর সাথে এরও একটা সম্পর্ক থাকতে পারে।"

সাদা নাকি লাল- কোন চিনিটা ভালো?

সব ধরেন চিনি শরীরের একই প্রভাব ফেলে সেটা সাদা হোক বা লাল হোক বা এগুলো দিয়ে তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার হোক। অনেকে কৃত্রিম সুইটেনারও গ্রহণ করেন। কিন্তু আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম সুইটেনার গ্রহণকারীদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক সময় বেশি থাকে।

স্বাস্থ্যে সকল সমস্যার মূলে মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবার

স্থুলতার জন্য মিষ্টি খাবারের একটা ভূমিকা থাকে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় কিছু স্থূলতার কারণ হতে পারবে না।
খাদ্য বিশেষজ্ঞ, রেনি ম্যাকগ্রেগর এর মতে,

"আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সুষম খাবারের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন।"

আসলে খাদ্য তালিকা থেকে চিনি কে বাদ দিয়ে দেওয়া বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনও হতে পারে চিনি বাদে আপনি হয়তো অতিরিক্ত  ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে বেশি শুরু করলেন- তাতে ক্ষতিই বেশি। চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ে জোরালো বিতর্ক আছে বলেই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর কিছু ফল যেগুলোতে শর্করা আছে, তার সাথে কোমল পানীয়কে গুলিয়ে ফেলছি। যাতে বাড়তি শর্করা ছাড়া অন্য কোন পুষ্টি উপাদান নেই।

চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার মানে তা খারাপ

ব্যাপারটা এমন নেতিবাচক চিত্রিত করি কারণ,

আমরা যে জিনিসটা আকর্ষণ ঠেকাতে পারি না সেটাকে অশুভ হিসেবে চিত্রিত করি। মিষ্টি খাবার তাড়না নিয়ন্ত্রণ করতেও আমরা এই জিনিস করি।

চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে ভুল ধারণা থাকলেও এটা সম্পর্কে বিষয় সত্যি। বেশি পরিমাণে মিষ্টি খাবার না খেয়ে পরিমিত হয় সবচেয়ে ভালো সমাধান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url