সমুদ্রের পানি কি আসলেই নীল?

সমুদ্রের পানি নীল নাকি অন্য কিছু তা জানার আগে আমাদের প্রকৃতির আলো ও রং সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক ধারনা রাখা দরকার।

আলো ও রং কি?

আমরা এই পৃথিবীতে যা কিছু দেখি না কেন তা কোনো না কোনো রঙের। প্রকৃতির কত কিছুর সৌন্দর্য্য তোমাদেরকে মোহিত করে। ময়ুরের পেখমের সৌন্দর্য্য, বিচিত্র রঙের প্রজাপতির সৌন্দর্য্য, ফুলের সৌন্দর্য্য, সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য আরো কতো কি! এ সব সৌন্দর্য্য এর মূল ভিত্তি হলো এগুলোর রঙ। কিন্তু এই রঙ কীভাবে তৈরি হয়? এই রঙ বলতে কিছুই থাকত না যদি না আলো ওই রঙগুলো তৈরি করত। মূল কথা আলোই রং সৃষ্টির কারণ। এখন আমরা আলো নিয়ে কিছু কথা জেনে আসি।

আপনারা নিশ্চয় জানেন যে আলো একধরনের বিদ্যুৎ চৌম্বুকীয় তরঙ্গ। বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যুৎ চৌম্বুকীয় তরঙ্গকে পরিমাপ করার জন্য “তরঙ্গদৈর্ঘ্য” শব্দটি ব্যবহার করেন। একক হলো ন্যানোমিটার(nm)। এখানে এক ন্যানোমিটার= ১ মিলিমিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ(1nm=.000001mm)। প্রতিটা আলোর জন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট। আলোর রঙ মূলত আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের কারনে তৈরি হয়। অর্থাৎ, ‘আলো’ নামক বিদ্যুৎ চৌম্বুকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে আলোর রঙ পরিবর্তিত হয়। যেমন- লাল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫৬০-৫৯০ nm, সবুজ রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৯০-৫৬০ nm, নীল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৫০-৪৯০ nm, বেগুনি রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০-৪৫০nm ইত্যাদি। অর্থাৎ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যখন ৬৩৫-৭০০ nm তখন তাকে লাল দেখায়, আবার একই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যখন পরিবর্তিত হয়ে ৪৫০-৪৯০ nm হয় তখন নীল দেখায়।

সমুদ্রের পানি কি আসলেই নীল?


সুতরাং দৃশ্যমান আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪০০-৭০০ nm এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর চাইতে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোর নাম অতিবেগুনি রশ্মি, রঞ্জন রশ্মি এবং গামা রশ্মি। আবার এই সীমার বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যগুলোর নাম ‘ইনফ্রারেড’ বা অবলোহিত রশ্মি। এগুলোকে সাধারনত আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।

বিভিন্ন বস্তু আমরা বিভিন্ন রঙে দেখি কেন?

বিভিন্ন বস্তু থেকে বিভিন্ন বঙের আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। কোনো বস্তুকে আমরা লাল রঙের দেখি কারণ সূর্য এর আলোকে রশ্মি যখন ঐ বস্তুর উপর পড়ে তখন ঐ বস্তু লাল বাদে বাকি সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর আলোগুলো শোষণ করে নেয়। তখন অশোষিত লাল আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। ফলে ঐ বস্তুকে আমরা লাল দেখি। যেই রঙের বস্তুই দেখি না কেন তার মানে হলো বস্তু ঐ রঙের আলো শোষণ করে না, বাকি সব রঙের আলো শোষণ করে। যখন আমরা কোনো সাদা বস্তু দেখি তার মানে হলো ঐ বস্তু কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর আলো শোষন করে না, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যর আলো প্রতিফলিত করে দেয়। আর সব রঙের আলোর সমষ্টি হলো সাদা রঙ। আবার কালো রঙের বস্তু দেখি কারণ ওই বস্তু সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর আলো শোষণ করে নেয়।

সমু্দ্রের পানি নীল কেন?

নীল আকাশের প্রতিফলনের কারণে বড় লেক বা সমুদ্রের পানি নীল দেখায় এটা আমরা সাধারণ ভাবেই ধরে নিই। কিন্তু এটা মূল কারণ নয়। আসলে সমুদ্রের পানির রঙ নীল এবং সে কারণেই মূলত সমুদ্র নীল দেখায়। কথাটা সহজে বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? মনে হয় পানির তো রঙ নেই। এক গ্লাস পানির দিকে তাকালেই এটা বোঝা যায়। তাহলে আমরা কীভাবে বলব যে পানির রঙ নীল? এ বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা পানিতে আলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

আমরা জানি সূর্য এর আলো বা রোদ মূলত ৭টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের সমষ্টি। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। এই বিভিন্ন রঙের আলো তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এর ভিত্তিতে পর পর সজ্জিত থাকে। এখন পানির একটি বিশেষ ধর্ম হল অপেক্ষাকৃত বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করা এবং কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ না করা। সুতরাং ‍সূর্য এর আলো যখন সমুদ্র পৃষ্ঠে পড়ে তখন লাল, কমলা ও হলুদ রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় তা কম শোষিত হয়। ফলে নীল রঙের

আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় তা কম শোষিত হয়। ফলে নীল রঙের আলো দ্রুত সমুদ্র গর্ভের প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত ঢুকে এবং অশোষিত নীল আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে লাগে।

ফলে এই নীল আলোর মিশ্রণে পানি কিছুটা নীলাভ রং ধারণ করে। কিন্তু এটা এতই সামান্য যে সহজে বোঝা যায় না। সমুদ্র বা বড় লেকের পানির পরিমাণ ও গভীরতা বেশি বলে সেখানে নীলের আধিক্য চোখে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের পানি নীল দেখায়।

এখানে আরো একটি কথা মনে রাখা দরকার- লবণ ও অন্যান্য খনিজের রঙও সমুদ্রের পানিতে কিছুটা দেখা যায়। পরিষ্কার নীল আকাশ থাকলে তার প্রতিফলনও সমুদ্রের পানিতে ঘটে। কিন্তু সেজন্য সমদ্রে মোটামুটি শান্ত থাকতে হবে আর সেই নীল আকাশের ছায়া দেখার জন্য একটু নিচু হয়ে অন্তত ১০ ডিগ্রির কম কোণে তাকাতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url