কীটনাশক কি এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীটনাশক কেন ব্যবহার করবো?

সাধারণত কীটনাশক রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ যা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে ব্যবহার করা হয়।
একজন সাধারণ কৃষকের ভাষায়, কৃষিজমিতে পোকামাকড় দমনে ব্যবহৃত পদার্থই হচ্ছে কীটনাশক।

কীটনাশক আবিষ্কার এর ইতিহাস

কীটনাশক আবিষ্কার এর ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়।উনিশ শতকের ষাটের দশকে আমেরিকার মিসিসিপিতে আলুখেত কলোরাডো আলু- বিটল দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রথম কীটনাশকের সাধারণ ব্যবহার শুরু হয়। প্যারিস গ্রিন নামে আর্সেনিকঘটিত একটি পদার্থ  উদ্ভিদ সংরক্ষক হিসেবে এতটাই ফলদায়ক হয়েছিল যে তা ১৯০০ সালের মধ্যেই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ইউরোপ ও আমেরিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিস গ্রিন মুলত আপেলের ক্ষতিকর মথ ধ্বংসে ব্যবহৃত হতো।কিছু কিছু কীটনাশক রয়েছে যেগুলো অ্যালকালয়েড বা বোটানিক্যাল নামে পরিচিত যেমন-রোটিনোন(rote none),নিকোটিন সালফেট(nicotine sulphate) এবং পাইরিথ্রয়েড(pyrithroid)। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী,কীটনাশক হিসেবে রোটিনন ১৮৪৮ সালে পাতাভুক্ত শুঁয়োপোকা দমনে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে ১৯০২ সালের পু্র্বে রোটেননের কার্যকর উপাদানটি পৃথক করা সম্ভব হয়নি। ধারনা করা হয় ১৮৯২ সালে কৃত্রিম জৈব রাসায়নিক পদার্থের প্রাথমিক ব্যবহার শুরু।এসময় জার্মানিতে ৪.৬-অর্থো--ডাইনাইট্রো কৃিসোল (4.6- dinitro- o-cresol)এর পটাশিয়াম লবন কীটনাশক হিসেবে বাজারজাত করা হয়।

১৯৩২ সালে a-বিউটক্সি-a-থায়োসায়ানোডাই ইথাইল ইথার (a-butoxy-a thiocyanodi ethyl ether)দিয়েই  সর্বপ্রথম পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃত্রিম জৈব কীটনাশক এর ব্যবহার শুরু হয়।
বিশ শতকের মধ্য দশকের বছরগুলো ছিল কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম কীটনাশক আবিষ্কার এর বিপ্লবকাল।সুইডিশ রসায়নবিদ পল হারমান মুলার (Paul Hermann Muller)কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি এর ব্যবহার অাবিষ্কার এর জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ডিডিটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৪০ সালে। ডিডিটি আবিষ্কার এবং মশা-মাছিসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ  নিয়ন্ত্রণে এটির সফল ব্যবহার রসায়নবিদ ও রাসায়নিক শিল্পগুলিকে বিভিন্ন প্রকারের নতুন কীটনাশক আবিষ্কার ও বাজারজাত করতে অনুপ্রাণিত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীটনাশক

বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৬ সালের পূর্বে তেমন কীটনাশক ব্যবহার হয়নি। ওই বছর সরকার প্রথম ৩ মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে ১০০% ভর্তুকিসহ কীটনাশক বিতরণ করত। ১৯৭৪ সালে এ ভর্তুকি ৫০%এ কমিয়ে আনা হয়।পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে ভর্তুকি সম্পুর্ন প্রত্যাহার করে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সরকার সবসময় ১৫-২০ মেট্রিক টন কীটনাশক মজুদ রাখে। এক সমীক্ষার তথ্যানুসারে বিশ শতকে আশির দশকের প্রথম দিকে কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে ১৩০০০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।এক জরিপে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৪৫ হাজার ১৭২ টন রাসায়নিক দ্রব্য ফসলে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত ১০ বছরে এর পরিমাণ বেড়েছে চার গুন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৮ টি কীটনাশক অন্যূন ১৫০ টি ট্রেডমার্ক সম্বলিত নামে তালিকাভুক্ত আছে।

কীটনাশক কি  এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীটনাশক কেন ব্যবহার করবো?

কীটনাশক কেন ব্যবহার করা হয়?

বিংশ শতাব্দীতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রধান নিয়ামক হিসাবে কীটনাশকের ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। জেনে নেয়া যাক কীটনাশক কেন ব্যবহার করা হয় এবং কোন ক্ষেত্রে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ঃ
১. পোকামাকড় দমনে-insecticide
২. ব্যাকটেরিয়া দমনে- milluscicide
৩. আগাছা দমনে- herbicide 
৪. ছত্রাক দমনে- fungicide  
৫. ইদুর বা দাঁত বিশিষ্ট প্রাণী দমনে- rodenticide 
৬. মাকর,মাইট দমনে-acaricide
৭. পাখি দমনে- avicide

কীটনাশকের বিষক্রিয়া

আমরা পূর্বেই জেনেছি কীটনাশক হচ্ছে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবন প্রক্রিয়ায় বিপর্যয় ঘটিয়ে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে ব্যবহার্য দ্রব্য। তবে এটি শুধু কীটপতঙ্গ নয়    মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্যও বিপর্যয় বয়ে আনছে। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মানব দেহে দেখা দিচ্ছে চর্মরোগ,কিডনির বৈকল্য,টিউমার,নানা ধরনের ক্যান্সার,লিউকেমিয়া, মহিলাদের স্তন ক্যান্সার, নানা স্নায়ু রোগ, হরমোনের ভারসাম্য সমস্যা,জন্মগত বিকলাঙ্গ সহ মারাত্নক ব্যাধি। কীটনাশক তৈরি হয় প্রমেনোফস, আগানো ফসফেট, সাইপারমেথ্রিন, বাইরেথ্রয়েড এর মিশ্রণে যা  মানুষ মারার জন্য যথেষ্ট।

আমাদের দৈনন্দিন খাবারের শতকরা ৯৮ ভাগ শাকসবজিতেই কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এসব বিষাক্ত পদার্থ খাদ্যশস্যে প্রয়োগের পর ১৫-২০ দিন কার্যকর থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় লিচু খেয়ে যে ১৪ জন শিশু মারা গেছে তারা মূলত কীটনাশক বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছে বলে চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছেন।এক গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার অঞ্চলের অধিবাসীদের স্নায়বিক বৈকল্যে ভোগের হার ২৫% যার জন্য অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার দায়ী। মানবদেহে কীটনাশকের ঘনত্ব ক্রমাগত বাড়ার ফলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।এছাড়া কীটনাশকের প্রভাবে জলজ প্রাণীর শূককীট ধ্বংস হয়ে যায়, ফাইটোপ্ল্যাংটনের সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায়। কীটনাশক মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলে পাখির এনজাইম প্রক্রিয়া ধীর হয়। এর প্রভাবে পাখির ডিম্বস্ফুরণ দেরিতে ঘটে।  এভাবে বহু পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৪০-১৪০ টি জীবের চিরবিলুপ্তি হচ্ছে।

কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা

প্রায় সকল ধরনের কীটনাশকই পরবর্তীতে জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু মানবদেহেই নয়,রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর। তাই কোন ফসলে কোন কীটনাশক ও কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার তা সম্পর্কে আগেই ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। রাসায়নিক প্রয়োগের পর সবজি ২১ দিনের মধ্যে রান্না করে খেলে তা বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসাবিদরা। তাই কীটনাশক ব্যবহারের এ বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু সকল কীটনাশকই এক ধরনের বিষ তাই এর ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্পর্কে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। সকল কীটনাশক ব্যবহারের আগে অবশ্যই হ্যান্ড গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং পরে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url