হিগস বোসন কণার অ আ ক খ
২০১৩ সালে
আবিষ্কার হবার আগে থেকেই হিগস নামের বোসন শ্রেণির কণাটি মিডিয়া জগতে খুব সাড়া
ফেলেছিল। কণা-পদার্থবিদদের নিকট যে জিনিসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো হিগস
ক্ষেত্র এবং হিগস মেকানিজম। হিগস ক্ষেত্র হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র, যে ক্ষেত্রের
সাথে মিথস্ক্রিয়া করার ফলেই মৌলিক কণাদের ভর সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে হিগস মেকানিজম
হচ্ছে হিগস ক্ষেত্রে কিভাবে ভর সৃষ্টি হয়, তার কৌশল। হিগস ক্ষেত্রের গভীরে যাবার
পূর্বে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা অত্যন্ত জরুরী।
কি এই হিগস ক্ষেত্র?
হিগস
ক্ষেত্র আমাদের ভর সৃষ্টি করে বলতেই অনেকের মাথায় ভেসে উঠে তার ৬০ কিংবা ৭০
কেজি ভরের জন্যও বুঝি ঐ হিগস ক্ষেত্রই দায়ী। আসলে তা নয়, ব্যাপারটি অন্যরকম। হিগস
ক্ষেত্র সর্বদা নিশ্চল সর্বদা নিশ্চল ভর নিয়ে কাজ করে। গতির কারণে যে আপেক্ষিক
ভরের সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে হিগস ক্ষেত্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের ভরের মাত্র ১
থেকে ২ শতাংশ নিশ্চল ভর। অর্থাৎ, ৭০ কেজির একজন ব্যক্তির শুধুমাত্র মৌলিক
কণাগুলোর যেমন- আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ইত্যাদির ভর যোগ করা হয় তবে তা
১ কেজিরও কম হবে এবং সেটাই নিশ্চল ভর। বাকি ভর আসে মূলত কোয়ার্কগুলোর প্রোটন ও নিউট্রনের মাঝে আলোর কাছাকাছি
গতিতে ছোটাছুটি করার কারণে। হিগস ক্ষেত্র একদম ঐ মৌলিক কণাগুলোর ভর প্রদান
করে কিংবা ভরযুক্ত কণাদের ভর বৃদ্ধি করে।
কিভাবে বোসন কণা 'ঈশ্বর কণা' হলো?
কণা- পদার্থবিদ লিওন ম্যাক্স ল্যাডারম্যান তার একটি বইয়ে হিগস
বোসন কণাকে ’ঈশ্বর কণা’ আখ্যায়িত করেছেন। যদিও বিতর্ক আছে যে এই কাজ তিনি করেননি,
বরং বইটির প্রকাশক বই এর কাটতি বাড়াতে এই কাজ করেছিলেন। সেটা যাইহোক,
সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে হিগস ক্ষেত্রে একটা সম্পর্ক থাকলেও হিগস বোসন কণাকে ঈশ্বর কণা
বলাটা হাস্যকর।
কিভাবে হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসনের উৎপত্তি?
এবার আসা যাক হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসনের উৎপত্তি কিভাবে হল তা
নিয়ে। হিগস বোসন কণা মূলত কণা- পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কণাদের ভর প্রাপ্তি ব্যাখ্যা করে।
স্ট্যার্ডার্ড মডেল বাদে অন্য আরও অনেক তত্ত্ব আছে যেগুলোতে হিগস ক্ষেত্র ছাড়াই ভর
প্রাপ্তি ব্যাখ্যা করা ছাড়াই ভর প্রাপ্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে
বলবাহক বোসন কণাদের একটা শ্রেণি আছে। এই শ্রেণির নাম ভেক্টর বোসন। এদের ভেক্টর
বোসন বলা হয়, কারণ এদের বোসনদের ভর শূন্য হবার কথা। কিন্তু, পরীক্ষণ থেকে দেখা
গেছে W ধনাত্নক বোসন, W ঋণাত্নক বোসন ও Z বোসনের ভর রয়েছে। ভেক্টর বোসনদের মাঝে আর আছে ফোটন ও গ্লুওন, যাদের আবার
ভর নেই। সুতরাং, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী মতে ভরের হিসাব মিলছিল না। যার
জন্য কণাদের ভর প্রাপ্তি ব্যাখ্যা করতে হিগস মেকানিজমের উৎপত্তি।
৬০ এর দশকে ৬ জন বিজ্ঞানী ৩টি স্বতন্ত্র দলে ভাগ হয়ে হিগস মেকানিজম ব্যাখ্যা করেন। প্রথমে দলে আছেন পিটার হিগস একাই। আর আছেন ফ্রাসোয়াঁ অ্যাংগলার্ট ও রবার্ট ব্রাউট এবং টম কিব্বল, জেরাল্ড গৌরালনিক ও সি. আর. হ্যাগেন।
হিগস মেকানিজমের মূল বক্তব্য কি?
হিগস মেকানিজমের মূল বক্তব্য খুব সহজ। মহাবিশ্বের সমস্ত স্থান-কাল জুড়েই হিগস ক্ষেত্র ছড়িয়ে রয়েছে। একটি কণা যখন হিগস ক্ষেত্রের মাঝে থাকে, তখন সেটা কণা মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে পারে, না ঘটাতেও পারে। যদি সেই কণা মিথস্ক্রিয়া না ঘটায় তবে তা ভরশূন্য থাকবে বা ভর বৃদ্ধি পাবে না (যদি পূর্ব থেকে ভরযুক্ত হয়)। আর যদি মিথস্ক্রিয়া ঘটায়, তবে ভর সৃষ্টি হবে বা পূর্বাপেক্ষা ভর বৃদ্ধি পাবে (যদি পূর্ব থেকে ভরযুক্ত হয়)। আর যদি মিথস্ক্রিয়া ঘটায়, তবে ভর সৃষ্টি হবে বা পূর্বাপেক্ষা ভর বৃদ্ধি পাবে (যদি ভর যুক্ত হয়)। যে কণা যত বেশি মিথস্ক্রিয়া ঘটায়, সে কণা তত বেশি ভর লাভ করে। যেমন- টপ কোয়ার্ক হিগস ক্ষেত্রের সাথে প্রচন্ড রকমের মিথস্ক্রিয়া করে অথচ ইলেকট্রন খুব সামান্য মিথস্ক্রিয়া করে।
এই কারণেই টপ কোয়ার্ক কণার ভর ইলেকট্রনের ভরের তুলনায় প্রায় ৩৫০০০০ গুন বেশি। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, যে টপ কোয়ার্কের আয়তনও হয়তো ইলেকট্রনের চেয়ে অনেক বড়।
আসলে টপ
কোয়ার্ক ও ইলেক্ট্রন, উভয়ই সমআয়তনের। কণা- পদার্থবিদ্যায় এদের বিন্দু-কণা হিসেবে
ধরা হয়। একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে যদি কোনো চার্জ রাখায় যায়, তবে সেই চার্জ হয়
আকর্ষিত হবে না হয় বিকর্ষিত হবে। কিন্তু, একটি নিরপেক্ষ কণা রাখলে তা আকর্ষিত বা
বিকর্ষিত হবে না। হিগস ক্ষেত্রও অনেকটা ঔরকম। কিছু কণা ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়া
করে, কিছু কণা করে না। হিগস ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার ফলে নিশ্চল ভরের
সৃষ্টি হয়।
হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসন কণার মধ্যে কি সম্পর্ক?
এই গল্পগুলোর সবই তো হিগস ক্ষেত্র আর হিগস মেকানিজমকে নিয়ে। এর
মাঝে হিগস বোসন কণা আসলো কোথা থেকে?
হিগস বোসন কণা হচ্ছে হিগস ক্ষেত্রের একটি কণা। মূলত কণাটির নাম হিগস কণা, কিন্তু কণাটি বোসন শ্রেণির কণা হওয়াতে একে হিগস বোসন বলে ডাকা হয়। বোসন হচ্ছে কণাদের একটি শ্রেণি, যারা বোস- আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে। এসব কণার স্পিন পূর্ণসংখ্যা ও বিভিন্ন বলের বাহক কণা হিসেবে কাজ করে।
বোসন কণা আবার দুই প্রকার। ভেক্টর বোসন ও স্কেলার বোসন। ভেক্টর বোসনদের স্পিন শূন্য হতে পারে না, অপরদিকে স্কেলার বোসনদের স্পিন সর্বদাই শূন্য। হিগস একটি স্কেলার বোসন কণা। হিগস ক্ষেত্রে আমাদের পরিচিত স্ট্যান্ডার্ড মডেলের হিগস বোসন কণা ছাড়াও আর ৩টি হিগস বোসন কণা রয়েছে। এরা গোল্ডস্টোন বোসন কণা নামে পরিচিত। ঐ ৩টি কণা যথাক্রমে W বোসনদ্বয় ও Z বোসনদ্বয়ের ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী।
খুব ভালোভাবে মনে রাখা দরকার যে, হিগস ক্ষেত্র তার নিজের ক্ষেত্র কণা হিগস বোসনকে ভর দিতে পারেনা। আবার নিউট্রিনোর ভর কেন আছে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। নিউট্রিনোর ভার পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হলেও গাণিতিকভাবে নিউট্রিনোর সাথে হিগস কণার মিথস্ক্রিয়া ঘটেনা। এটি এখন পর্যন্ত অমিমাংসিত একটি সমস্যা।
হিগস বোসনের প্রাপ্তিগুলো কি কি?
হিগস ক্ষেত্রের বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব প্রমান করতে হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ অনেক পরীক্ষণ- নিরীক্ষণ শেষে সার্নের লার্জ হ্যাডেন কোলাইডারের সিএমএস (কমপ্যাক্ট মুওন সলিনয়েড) এবং অ্যাটলাস (এ টরয়ডাল এলএইসচিজ অ্যাপারাটাস) ডিটেক্টরের বিজ্ঞানীরা হিগস বোসন কণা খুঁজে পাওয়ায় হিগস মেকানিজমের সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে এবং পিটার হিগস ও অন্য ৫ জন বিজ্ঞানীও ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছেন। নোবেল কমিটিও তাই আর দেরি করেনি! ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে পিটার হিগস ও ফ্রাসোয়াঁ অ্যাংগলার্টকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করে তারাও ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে।